বুমেরাং
-চিন্ময় মহান্তী
১
দশম শ্রেনীর গণ্ডি পেরিয়ে এবছর একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছে তিতলি । নতুন স্কুলে এসে তার নতুন বান্ধবী হয়েছে রিয়া । বন্ধুত্বের দিন কয়েক পর একদিন ক্লাসের ফাঁকে তিতলি দেখল , রিয়া একটা স্মার্ট ফোন বের করে কি সব করছে । তার কৌতুহল হলো । সে রিয়ার আরো একটু কাছে এগিয়ে দেখল , সে ফেসবুক খুলে কি যেন করছে । স্মার্ট ফোন তো স্বপ্নের কল্পনা , তিতলি এখনো কীপ্যাড ফোনও ভালো করে হাত দিয়ে দেখেনি । রিয়ার হাতে স্মার্ট ফোন দেখে তার আগ্রহ প্রবল হলো । সে বলল , ” দে না রিয়া একবার দেখি । ” রিয়া তার হাতে ফোনটি দিতেই তিতলি সেটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল । কি সুন্দর সোনালী রঙের পাতলা একটি ফোন । দেখেই তার মনে সেরকম একটি ফোন পাওয়ার আকাঙ্খা বাসা বাঁধল , সে রিয়াকে জিজ্ঞেস করল , ” কত দাম রে রিয়া ? ” ” বারো হাজার, ” বলেই রিয়া ফোনটি তিতলির হাত থেকে নিয়ে মন দিল ফেসবুক চ্যাটে । অপরের জিনিসের প্রতি নিজের অধিকার থাকে না অথবা সেটি কেনার সামর্থ থাকে না বলে অনেক সময় শুধুমাত্র চোখের দর্শন তৃষ্ণা পরিতৃপ্ত করার জন্য যেরূপ দূর হতে সেই কাঙ্খিত দ্রব্যটির প্রতি অসামর্থ ব্যক্তি তাকিয়ে থাকে , তিতলিও সেরকম দেখতে লাগলো । এমন সময় পাশাপাশি বসে থাকা মেয়েদের মধ্য হতে একটি সোরগোল উঠল , ” চল চল ম্যাডাম ক্লাসে যাচ্ছেন । ” রিয়া তড়িঘড়ি ফোনটি উড়নার নিচে লুকিয়ে ক্লাসে চলে গেল । তিতলিও তার পিছুপিছু গেল ।
সুবিকাশ তিতলির বাবা । তিনি উঠানে কয়েক গোছা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ঝুড়ি বুনছিলেন । এই ঝুড়ি বিক্রি করে যেটুকু আয় হয় তাতেই দিনাতিপাত হয় । তিতলি স্কুল থেকে ফিরে বাবার কাছে এসে দাঁড়ালো । সে সচরাচর এমন করে না , স্কুল থেকে ফিরে সোজা ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রেখে হাঁক দেয় , ” মা খেতে দেবে এসো । ” আজকে মেয়ের এমন ব্যতিক্রম আচরণ দেখে সুবিকাশ বললেন , ” কিছু বলবি মা ! ” তিতলি আমতা আমতা করে বলল , ” বাবা , আমার বান্ধবী রিয়া , স্মার্ট ফোন নিয়ে স্কুলে যায় । আমাকে একটা কিনে দাও না । ” স্মার্ট ফোন সম্পর্কে সম্পূর্ন অজ্ঞ তিতলির বাবা মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন , ” কত দাম মা ? ” তিতলি বাবার এই প্রশ্নে খানিক প্রফুল্ল হয়ে বলল , ” বেশি নয় দশ – বার হাজার মাত্র । ” তিতলির কাছে যেটি মাত্র , সুবিকাশের কাছে যে সেটি বিস্তর তা তিতলির ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বুঝলো না । সুবিকাশ সরাসরি অসম্মতি জানিয়ে মেয়েকে কষ্ট দিতে চাইলেন না । নিরস কন্ঠে বললেন , ” দেখছি ! ” পিতার বাক্যে আশা পেয়ে তিতলি ঘরে ঢুকল ।
২
দু’ মাস কেটে গেছে । তিতলির বাবার দেওয়া কথা এখনো বাস্তবায়িত হয় নি। তিতলি আগের মতোই স্কুলে গিয়ে , ক্লাসের ফাঁকে রিয়ার ফোনটির দিকে তাকিয়ে থাকে । তার এইরূপ একটি ফোন প্রাপ্তির আকাঙ্খা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে । এই নিয়ে ইতিপূর্বে সে তার বাবাকে দু’ চারটি কড়া কথা শুনিয়েছে । বাবা তার অক্ষমতা বোঝাতে সমর্থ হন নি। মা বার বার বলেছেন , ” জেদ করিস না মা , আমাদের সংসার খুব কষ্টে চলে । তার উপর তুই যদি এমন জেদ করিস , কি করি বলতো ! ” মায়ের কথায় সেদিন তিতলি চুপ করেছে । এর জন্য হয়তো তিতলিকে দায়ী করা যায় না । এই বয়সে এই রকম একটা জেদ মনের মধ্যে সৃষ্টি হয় । যারা একে জয় করতে পারেনা তারা বিমুখ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে । আর তার ফল ভয়াবহ রূপে দেখা দেয় । বিপরীত পক্ষে এই জেদ যদি পড়াশোনা মুখী হয় তাহলে একটি সুফল লাভ হয় । কিন্তু কার্যত বহু ক্ষেত্রেই এটি বাহ্যিক চাহিদা মুখী হয় , যদি পিতা মাতার মধ্যে সন্তানের আবদার মেটানোর অত্যধিক প্রবনতা থাকে । তিতলির ক্ষেত্রে তাই হলো । সেদিন রিয়া ফোনটি নিয়ে কি করছিল , তিতলি অধিক কৌতুহলী হয়ে ফোনটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল , ” দেখি দেখি একবার দে। ” রিয়া তিতলির এই আচরনে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল , ” দিন দিন কত দেখবি , একটা কিনে নিলেই পারিস তো । ” রিয়ার কথা শুনে তিতলির মনের অতল হতে না পাওয়ার একটি কষ্ট বুদবুদের আকারে বিবেকে আঘাত করল । আজ এই অপমানের জন্য নিজের বাবার অসামর্থতাকে দায়ী করে চুপ করে সে সেই স্থান ত্যাগ করলো । রিয়া ফোন নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিল , বান্ধবীর হৃদয়ে যে একটি অপমানের তির সে বিঁধল তা বুঝতেই পারল না । তিতলি স্কুলের সারাটা সময় মন খারাপ করে কাটাল । একবারের জন্যও আর রিয়ার মুখোমুখি হলো না ।
স্কুল থেকে ফিরে কাউকে কিছু না বলে সে ঘরে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধ করে খিল তুলে দিল । খিল তোলার শব্দে তিতলির মা ছুটে এসে দরজা চাপড়ে বলতে লাগলেন , ” কি হলো মা ? দরজা খোল । ” স্ত্রীর হাঁকডাকে সুবিকাশ হাতের কঞ্চিগুলো উঠানে ফেলে ছুটে এলেন । বাবা মায়ের তীব্র আর্ত আহ্বানে তিতলির কোনো সাড়া পাওয়া গেল না । ছোটো থেকে আদরের মেয়ের সমস্ত আবদার মিটিয়ে , মেয়ের কাছে দারিদ্রতাকে লুকিয়ে রেখে সুবিকাশ যে একটা বড় ভুল করেছিলেন তা বুমেরাং হয়ে তার কাছেই ফিরে এলো ।
খুব ভালো লাগলো গল্প